একদিন দুদিন প্রতিদিন

স্যার, আপ ব্যাগ ভুল গয়ে।

ব্যাগটা নিয়ে রুমের বাইরে বেরোতেই গম্ভীর বাতাস ধাক্কা মারলো। লোকে বলে, এই করিডরে নেশা আছে। করিডর ঘেঁষা সারি সারি লাল-সবুজ বাতি লাগানো ঘরের ভেতর দেশ কেনাবেচা হয়, দেড় বিলিয়ন মানুষের ভাগ্যে সিলমোহর লাগানো হয়। আর আমি প্রতিদিন সকালে ল্যাপটপের ব্যাগ নিয়ে যখন লাল কার্পেটের উপর দিয়ে হাঁটি, মোটা দেয়ালের পুরোনো গন্ধ আর বন্ধ দরজার সামনে বসে থাকা আর্দালির আলসেমির ছন্দ, নেশাই  লাগিয়ে দেয়। মাঝে মাঝে যখন রাত বাড়ে, আর নেভানো বাতি গুলো বলেসাহাব নেহি হ্যায়’, আমি ফেরার গতিবেগ কমিয়ে দিই।  দিনভরের হাস্যকর শূন্যতা আর শীতল নির্মমতা তখন ঘুমিয়ে পড়া ফুটপাথের বাচ্চার মতো থিতনো - আর আমার সাথে দেখতে গেলে তখন কলকাতার বুড়ো ট্রামেরও  অনেক মিল।  দুজনেই নির্লিপ্ত চোখে ভাবি, এই শেষ বার।  কাল আর না। 

আমি ঐশিকার শরীর খারাপের খবর পেলাম এই ফাঁপা করিডোরেই।  তানিয়ার মা অত্যন্ত কঠিন মহিলা।   আর যখন তিনি বললেন যে ঐশিকা না পারছে খেতে, না পারছে ঠিকঠাক শ্বাস নিতে এবং ডাক্তার বলছে এখুনি হাসপাতালে ভর্তি করতে, তখন আমি নর্থ ব্লকের লাল করিডরের এক প্রান্তে - ভাবলাম, আমি বাবা হওয়ার সেই দিকটা অবশেষে দেখতে চলেছি, যেটার ভয়ে অনেকে বাবাই হতে চায়না। পরের দিন সকাল বেলা ফ্লাইট থেকে নেমে ঐশিকার হাতে তিনটে বেঁধা সুঁচ, ঝোলানো স্যালাইন আর চোখ ভরা আকুতি দেখে পালাতে গিয়েও পালাতে পারিনি। শুধু কোলে নিয়ে মাথায় গায়ে হাত বুলিয়েছি আর মনেমনে মন্ত্রের মতো আওড়েছি, “ঠিক করে দাও ভগবান।  প্লিজ ঠিক করে দাও।আমি এমনিতে নাস্তিক, তবে এমন সময় আমি আঁতেল হয়ে যাই।

তানিয়ার মামা ওদিকে আইসিউ তে ভর্তি। ফুসফুসে মারাত্মক সংক্রমণ। তিনদিন পরেও যখন ঐশিকার কাশি কমলনা, তখন হাসপাতাল থেকে জোর করে বের করিয়ে সল্টলেকের এক পুরোনো ডাক্তারকে দেখালাম। সেই তানিয়ার ছোটবেলাকার আমলের। পুরোনো ডাক্তার বললেন ধুলো থেকে কফ আর শ্বাসকষ্ট। চিন্তার কিছু নেই। নতুন ওষুধ দিলেন আর তার সাথেপুরোনোএকালের ডাক্তারকে গালি।

মামাকে দেখলাম কাঁচের ওদিকে। মুখ জোড়া অক্সিজেন মাস্ক আর নাকের ভেতর খাদ্য নল, আর একটা স্ক্রিনএর পাশে মামার চোখ আধবোজা - স্ক্রিনএ হরেকরকম নম্বর। ডাক্তার বলেছে ফুসফুস প্রায় অকেজো, আর তাই শরীরে কার্বন-ডাই-অক্সাইডএর পরিমান স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক বেশি। এমন চললে ভেন্টিলেশন ছাড়া আর কোন রাস্তা নেই। তানিয়ার মামা নরম প্রকৃতির মানুষ। আর আমার মতো বিরক্তিকর প্রাণীকেও যখন তিনি আদর করেন, তখন আমি ধরেই নিয়েছি যে মামা অনেকটা জাতক গল্পে পড়া ভালোমানুষ। মানুষের দুষ্টুমি দেখা যাদের মাসকাবারি অভ্যেস, তারা এরকম ভালোমানুষকে কষ্ট পেতে দেখলে কি করে উঠবে বুঝে উঠতে পারেনা। নার্সিংহোমের নিচে কোনার দিকের চায়ের দোকানটায় সিগারেট পাওয়া যায়।  অনেকদিন সিগারেট ছুঁইনি। একটা লাইট খেলে বেশ হত।  চায়ের অর্ডার দিয়ে আগুন জ্বালাবো, তানিয়া ফোন করল।

আমি কলকাতা আসতে চাই। একদিনের জন্য হলেও।

মেয়েটা পাগল। বিশাল একটা বড় কনফারেন্স সামনে, তাই ছুটি পাওয়ার চান্স্ জিরো। টিকিটের দামও লাখের উপরে। অন্য সময় হলে তানিয়ার অসহায় অবস্থা লংকার চাটনির মত তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করা যেত। কিন্তু মেয়েটা ফোঁপাচ্ছে। কান্নাকে উপহাস করা যায়, কিন্তু ফোঁপানোকে নয়। আমি যদি চিত্রগুপ্ত হতাম আর কাউকে সবচেয়ে বড় শাস্তি দিতে হত, তাহলে আমি তাকে এরকমই অসহায় করে দিতাম। বেশ হতো দুষ্টু লোকেদের কাঁদতে দেখে। কিন্তু তানিয়ার দুষ্টুমি অন্যরকম, আমার অনেক পছন্দের। তার উপর কলকাতা এলে সবাইএর নরম হয়ে যাওয়াটাই নিয়ম। তানিয়াকে বললাম, চলেই আয়। যদিও আমি জানি, আসবে না। মাথা একটু সচল হলেই অঙ্ক কিলবিল করবে, আর তখন আবার সেই পুরোনো তানিয়া, যাকে কাঁদতে দেখার জন্য আমি লাখ টাকাও দিতে রাজি। সেই কোন ছোটবেলায়, যখন হলদিয়ায় ব্যাঙ্কে কাজ করতাম, এক রাতে আয়নার সামনে তাকে কাঁদতে দেখেছিলাম। আই হেট্ মাইসেল্ফ, আই লাভ মাইসেল্ফ এর আগে কোনো মেয়ে আমার সামনে এমন করে কাঁদেনি - তাও আবার জীবনের সবচেয়ে বড় প্যারাডক্স নিয়ে। ভালোবেসে ফেলা ছাড়া অন্য কোন রাস্তা ছিল না। মেয়েটা যদি একদিনের জন্যও কলকাতা আসে, মিনিট পাঁচেক হাত ধরে হাঁটা যেতে পারে।

কিন্তু তানিয়া এলনা। আর বিকেল থেকে আমারও মনখারাপ শুরু হলো। বেদান্তিকা আমাদের মেয়ে কম, বন্ধু বেশি। আর সে এখন দিদির বাড়িতে, সেই পাঁশকুড়ার কাছে মেচগ্রামে। আমি তিনদিন হল কলকাতা এসেছি, কিন্তু বেদান্তিকার কাছে যাওয়ারও সময় হয়নি।  ওকে বলাও হয়নি যে আমি এসেছি - হয়ত মনখারাপ করবে। কাল ফেরা। দেখা হবে না? ধুস। আমি আজ চলেই যাব, সে যতই রাত হোক। মাঝরাতে ঘুম থেকে উঠে বেদান্তিকা দেখবে আমি পাশে - আমি জানি কি করবে - গুটিশুটি মেরে আমার বুকের মাঝে মাথা গুঁজে দেবে আর ঘুমের মাঝেও আমার গোঁফ ছুঁয়ে দেবে। আমি আধো অন্ধকারে ওর উঁচু কপালে চুমু খাবো। চারবার। সকালবেলা সময় থাকলে ঘুম থেকে উঠে পিপির দেওয়া নতুন খেলনা, রঙের বাক্স, জামা দেখাবে, আর নতুন শেখা বাংলা গানটা শোনাবে। চলেই যাই।

গোটা একটা সপ্তাহ গিলে ফেললো আমার চেয়ার, ল্যাপটপ আর বিরক্তিকর অফুরন্ত কাগজ। অফিসে সময় কাটে সকালের দিকের কর্পোরেশনের জলের মত। প্রয়োজনের অতিরিক্ত স্পিড। তানিয়া কনফারেন্স নিয়ে ব্যস্ত, ফোন করার সময় মাঝরাত। ঐশিকা ভালোর দিকে, তবে কাশি এখনো যায়নি। বেদান্তিকার জন্মদিন সামনে, তবে এবার পালন হবে কিনা জানিনা। মামা ভেন্টিলেশনে। বাড়ির সঙ্গে ঠিকঠাক কথা হয়না আজকাল। মাকে শেষ কবে ফোন করেছি ভুলেই গেছি। ছড়ানো অবস্থা আমার। শনি-রবি দুদিন ছুটি। একেবারে শেষ মুহূর্তে ঠিক করলাম যে কলকাতা যাবো। মাসের পুরো স্যালারিটা টিকিটেই যাক।

মামার শরীর হঠাৎই আরো খারাপের দিকে। সবার চোখে দেখলাম বিকেলের রোদের শুকনো ছায়া। তানিয়ার মাকে এতটা থমথমে আগে কখনো দেখিনি। বিপদ কখনো একা আসেনা। মামার বড়মেয়ে তুলিও ভর্তি হল হাসপাতালে। সময়ের আগেই ডেলিভারি। ডাক্তার বলেছে স্ট্রেস থেকে। একই বাড়িতে একদিকে যখন জীবন রাখার লড়াই, অন্যদিকে তখন জীবন আনার।

তুলির ছেলে হয়েছে। যখন লিফট দিয়ে উঠছিলাম, তুলির হাসব্যান্ড পাপাই এর চোখ দেখলাম ক্লান্ত, উদ্বিগ্ন অথচ সহনশীল। একদম বাবাদের মত। নার্সকে অনুরোধ করতে, কোলে করে নিয়ে এলেন নরম কম্বলে মোড়া ছোট্ট পুতুলটাকে। চোখ বন্ধ, অথচ বেশ কান্না কান্না ভাব। নার্স বললেন দুধ খাচ্ছিল। খাওয়ার সময় ডিস্টারবেন্স বাঙালি একদম পছন্দ করেনা। মনটা হঠাৎই ভালো হয়ে গেল। নতুন জীবন দেখা ভাগ্যের ব্যাপার। সবকিছুকে বদলে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে এরা। ফেরার সময় দেখলাম তুলি তার কেবিনে ঘুমোচ্ছে। পাপাই এর চোখ আরো নরম, অনেকটা ভালো স্বপ্ন দেখে ওঠা বাচ্চার মত।

আমি অবশেষে বেদান্তিকার কাছে যাচ্ছি। ট্যাক্সিতে গাদাগাদি করে পাঁচজন। তিননম্বরে তবে নেমে যাব - তারপর বেলঘড়িয়া এক্সপ্রেসওয়ে হয়ে বোম্বে রোড হয়ে মেচগ্রাম। অনেকটা রাস্তা। যশোর রোডের আড়াই নম্বরের জ্যামে গাড়ি ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। উবেরের ড্রাইভারটা অল্পবয়সী - বোধহয় একটা গালাগাল দিতে গিয়েও দিতে পারলো না।  বাকি সবাইও বেশ বিরক্ত। আমার পৌঁছুতে বেশ রাত হয়ে যাবে, কিন্তু তবু আমার বিরক্তি আসছে না। বাইরে ঝিরঝিরে বৃষ্টি ধরল। মন বলছে, বৃষ্টি থামার না।

Comments